মোঃ সাইমুন ইসলাম, কুয়াকাটা পটুয়াখালী: এক জোড়া গরু অথবা মহিষের কাঁধে জোয়াল তুলে দিতে তাতে লাঙ্গল লাগিয়ে শতবছর ধরে হালচাষ করে আসছিল দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক পরিবার গুলো। শুধু দক্ষিণাঞ্চল বলে ভুল হবে হালচাষে গরু মহিয়ের ব্যবহার একসময় সারা দেশে প্রচলিত ছিল। ফসল ফলাতে জমি চাষ লাঙ্গল দিয়ে করতো কৃষক পরিবার গুলো। তাই সচ্ছল কৃষক পরিবার গুলোর প্রত্যেক বাড়িতে ছিল গরু মহিষের একাধিক হাল। শুধু হালচাষ নয় গরু মহিষ ব্যবহার হতো গাড়ি চালাতে। এখনো মাঝে মাঝে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়ি কৃষিপণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার হতে দেখা যায়। তবে হালচাষে গরু ও মহিষের ব্যবহার নেই বললেই চলে।
গরু মহিষের হালচাষের জায়গা দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক যানবাহন ট্রাক্টর ও শ্যালো চালিত পাওয়ার টিলার। সারা দেশে কৃষিতে যান্ত্রিক ব্যবহার বেড়েছে। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ফসল চাষেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন সারা বছরে জমিতে কোন না কোন ফসল ফলাচ্ছে কৃষক। একই জমিতে ১২ মাসে ৩/৪ টি ফসলও ফলাচ্ছে কৃষক। এখন ফসলের জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে দিনরাত্রি জমি চাষ করা যায়। গরুর বা মহিষের হালে সেটা সম্ভব ছিল না। গরু বা মহিষের হালে একজন কৃষি শ্রমিক এক দুপুর জমি চাষ করতে পারতো। রাতে লাঙ্গলের চাষ ছিল অসম্ভব ব্যাপার। গত ১৩/১৪ বছর আগেও একজন কৃষক অথবা কৃষি শ্রমিক নিজ হাতে জোড়া গরুর দড়ি তুলে নিয়ে গরু অথবা মহিষের কাঁধে জোয়াল তুলে দিয়ে মাঝখানে লাঙ্গল ইস জোয়ালের মাঝে বেঁধে গরু অথবা মহিষের হালচাষের দৃশ্য প্রতিটি গ্রামে দেখা যেত।
গরু দিয়ে হালচাষ এক সময় ছিল গ্রামবাংলার চিরায়িত চিত্র। মাঠ হতে ফসল তুলার পর শুরু হতো হালদিয়ে জমি চাষের কাজ। ভোর হলেই গ্রামাঞ্চলের কৃষক অথবা কৃষি-শ্রমিকরা কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে গরু মহিষ ঞাঁকিয়ে জমিতে হাল চাষের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। লাঙ্গলের চাষ কৃষক জমিতে এক দুপর দিত। এক দুপুরে এক দুই বিঘা জমি এক-চাষ করা ছিল খুবেই কষ্টের ব্যাপার। ঘুরে ঘুরে চাষ করতে হতো। সেই সাথে শক্ত-হাতে চেপে ধরতে হতো লাঙ্গল। এতে শক্তি ও কৌশলের প্রয়োজন ছিল। একটু কম বেশী হলেই গরু অথবা মহিষের পায়ে লাঙ্গলের ফলা ঢুকে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়ে যেত। আবার যে কৃষক বা কৃষি-শ্রমিক হালচাষ করতো তাকেও সবসময় মনোযোগী ও সর্তক থাকতে হতো। তার পায়েও লাঙ্গলের ফলন লাগার সম্ভাবনা ছিল। বেশীক্ষণ হালচাষ করলে কৃষকের মাথা ঘুরানি ধরে যেত। এখন সেই কষ্ট নেই।
বর্তমানে অত্যাধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে হালচাষ ও কৃষিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হালচাষ, বীজরোপন, ধানের চারারোপন, বীজ ছিটানো, ধানকাটা, ধান মাড়াই, শস্য পরিবহন, ধান সিদ্ধ-শুকনো ও ধানভাঙ্গাতে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। এমন কি জমির আগাছা মুক্ত করতেও ব্যবহার হচ্ছে যন্ত্রপাতি। কৃষি বিঞ্জানীগণ কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। ফলে কৃষকদের জীবনেও এসেছে নানা পরিবর্তন। চাষবাদে সময় কমে এসেছে, যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচ কমে এসেছে। সাশ্রয় হয়েছে কৃষকের শ্রম ঘণ্টা। আগে শুধু দিনের বেলায় হালচাষ করা যেত। এখন যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় রাতেও হালচাষ করা যায়। কৃষকের এখন দিনরাত্রি বদলে গেছে জীবন-যাত্রার মান। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সারা দেশের ন্যায় পটুয়াখালী জেলার গ্রামগঞ্জে। এখন আর কৃষকদের কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল ও হাতে জোড়া গরুর দড়ি দেখা যায় না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষের পদ্ধতি। এক সময় গ্রামগঞ্জে গাঁথা পদ্ধতিতে ( কয়েকজন মিলে) গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষ করা হতো। এখন গ্রামে গাঁথা পদ্ধতির প্রচলন উঠে গেছে।
এখন যন্ত্র ও পাশাপাশি কৃষি শ্রমিক দিয়ে সকল চাষের কাজ করা হয়। কৃষিকাজে কৃষকের সম্মান বেড়েছে। বেড়েছে কৃষি শ্রমিকের কদর। এখন একজন কৃষি শ্রমিক ফসলের মাঠে কাজ করলে এলাকা ভেদে ৪ শত হতে ৫শত টাকা দৈনিক মুজরি পায়। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসানইন মোহাম্মদ এরশাদ এর করা কৃষি শ্রমের মজুরি আইন এখন আর হয় না। কৃষি শ্রমিকের মজুরি আইনে একজন শ্রমিককের মজুরি নির্ধারণ ছিল দেড় কেজি চাল, নগদ ১০ টাকা, সকাল ও দুপুরের খাবার দেয়ার বিধান। এভাবে বহুকাল ধরে এদেশের কৃষক কৃষি শ্রমিকের মুজরি মিটিয়ে ছিল। এখন কিন্তু এই মজুরিতে কোথাও শ্রমিক পাওয়া যাবেনা। গরু, মহিষের হালচাষ বিলুপ্ত হলেও গ্রামে গরু মহিষ প্রতিপালন কিন্তু কমেনি। বরং বেড়েছে। লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে খামার করে মধ্যবিত্ত কৃষকেরা গবাদিপশু পালন করছে। মাংস ও দুধের জন্য এই খামার স্থাপন হয়েছে। অনেকে আবার গরুর খামার কে লাভজনক পেশা হিসেবে বেঁচে নিয়েছে। আগে প্রতিটি বাড়িতে হাল চাষের জন্য গরু মহিষ লালনপালন করতো কৃষক পরিবার গুলো। এমন দেখা গেছে, যাদের কোন জমি ছিলনা। চাষাবাদ করতো না এমন পরিবারেও গরু মহিষ পালন করতো হালচাষের জন্য। তারা শুধুমাত্র গরু, মহিষ দিয়ে হালচাষ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন গরু মহিষ দিয়ে হালচাষের পেশাটির বিলুপ্ত ঘটেছে।
তবে সেই জায়গায় গ্রামের অনেক পরিবার যাদের চাষের জমি নেই। তারা উন্নত-জাতের গরু মহিষ পালন করতে দুধের জন্য। প্রতিদিন দুধ বেঁচে তারা সংসার চালায়। বিশেষ করে চরাঞ্চলে ব্যাপক দুধের উৎপাদন হয়। জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার শৈলমারীর তিস্তার চরের উৎপাদিত দুধ প্রাণ ও মিল্ক-ভিটা প্রত্যহ তাদের বিশেষায়িত ট্রাক ভ্যানে করে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে।
শৈলমারী চরের করিম উদ্দিন(৫০) জানান, এক সময় বিঘাপ্রতি চুক্তি করে অন্যের জমিতে হাল চাষাবাদ করে নিজের পরিবারের ভরণ-পোষণ করতেন অনেক শ্রমজীবী কৃষক পরিবার। কিন্তু বর্তমানে লাঙ্গলের হাল চাষ আর চোখে পড়ে না। লাঙ্গলের হালচাষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জেলা সদরের মহেন্দ্রনগরের কৃষক আব্দুর রহমান(৪৫) জানান, কয়েক বছর আগে একসময় গরু দিয়ে জমি চাষ করাই আমার পেশা ছিল। এখন গরুর হাল দিয়ে জমি চাষাবাদ কেউ করান না। তাই লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ করা বন্ধ রয়েছে। হালচাষের পদ্ধতিটা ছোট বেলায় বাবার সাথে হাল চাষের কাজ করতে করতে শিখে ফেলে ছিলাম। বাড়িতে হাল চাষের বলদ থাকত ২-৩ জোড়া।
তিনি বলেন, গরু দিয়ে হাল চাষের অনেক উপকারিতা ছিল। লাঙ্গলের ফলা মাটির অনেক গভীরে যায় তাই জমির মাটি ভালো আলগা ও নরম হয়, ধান চাষের জন্য কাদাও অনেক ভালো হয়। গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাসও কম হয়। আর ফলনও ভালো হতো। লাঙ্গল দিয়ে প্রতিদিন জমি চাষ করা সম্ভব হতো প্রায় ৪৪ শতাংশ। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে জমি চাষ করার পদ্ধতি এখন বদলে গেছে। নতুন নতুন মেশিনের সাহায্যে কৃষকরা কম সময়ে ও কম খরচে জমি চাষাবাদ করছেন। তাই কালের বিবর্তনে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে গরু দিয়ে সেই হাল চাষ। গ্রামের ফসলের দোলায় দেখা যায় ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক সব যন্ত্রপাতি দিয়ে চলছে ফসলের জমিতে চাষাবাদের কাজ। কৃষিতে এখন বাণিজ্যিকরণ ঘটেছে। ফসলা চাষেও এসেছে বৈচিত্র্য। কৃষকগণ এখন প্রচলিত কৃষি পণ্যের পাশাপাশি সবজি, ফলমূলসহ নানা শষ্য উৎপাদন করছে। এখন গবাদিপশু পালন কে অনেকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। এতে আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কৃষিতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন।
বৈশিকাবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে কৃষিতেও এসেছে বৈচিত্রতা। যন্ত্রপাতির পাশাপাশি কৃষিতে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। কৃষির এই পরির্বতনে কৃষি বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি কৃষক নিজেই নানা পরিক্ষানীরিক্ষা চালিয়ে নতুন কৃষি প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি বানিয়েছে। এমন কি উচ্চ ফলনশীল জাতও কৃষক আবিষ্কার করেছে। কৃষিতে মান্দাতা আমলের ধ্যানধারনা পাল্টে গেছে।
লালমনিরহাট কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিধু ভূষণ রায় জানান, বর্তমানে কৃষিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। কৃষি কাজেও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। যে কৃষি জমিতে বছরে দু খন্দের আবাদ করা হতো সেই জমিতে এখন তিন/চার খন্দেরও আবাদ করা হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ এখন লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষের পরিবর্তে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করছে। প্রাণী দিয়ে হালচাষ করার পদ্ধতি উঠে যাওয়ায় জমি চাষে কৃষিতে খরচ কমেছে। সময় বেঁচে যাচ্ছে।